সারা বছর কাকীমা-দিদিমা, কালীপূজোয় শুধুই বুড়িমা । কালীপূজোয় চকলেট বোম ফাটাতে অনেকেই পছন্দ করেন । কালীপুজোয় বোম ফাটান অথচ বুড়িমার নাম শোনেননি এমন লোক খুবই কম আছে । বুড়িমার চকলেট বোম ছিল এককালে সবচেয়ে বিখ্যাত । বর্তমান প্রজন্ম হয়ত চকলেট বোম দেখেনি, কিন্তু বুড়িমা এখনো চলছে রমরমিয়ে বিভিন্ন ধরনের আতসবাজির পসরা সাজিয়ে । বুড়িমার নাম অনেকেই শুনেছেন কিন্তু বুড়িমার নামের পিছনে রয়েছে যে রহস্য তা অনেকেরই অজানা । তাহলে জেনে নেওয়া যাক এই বুড়িমা আসলে কে…
ধার করা দশটা একশো টাকার নোট । তাই দিয়ে নানা রকম বাজি কিনে দোকান সাজিয়ে বসলেন । জমল বিক্রিবাটা । তিন দিনের মাথায় পুলিশ এসে হাজির । বাজি বিক্রির লাইসেন্স আছে ? বাজি বিক্রি করতে লাইসেন্স লাগে, জানা ছিল না । বললেন, “এ বারের মতো ছেড়ে দিন ।” কাজ হল না । বাজি বাজেয়াপ্ত করল পুলিশ, গুঁড়িয়ে দিল দোকান । জেদ চেপে গেল । বাজির ব্যবসাই করবেন তিনি । করলেনও । ধীরে ধীরে বাংলার বাজি ব্যবসায় এক নম্বর জায়গাটি পাকা করে ফেললেন অন্নপূর্ণা দেবী । সবার ‘বুড়িমা’ ।
দেখুন সেই বুড়িমার ছবি
কালীপূজো হোক বা কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান অথবা কোনো বিশেষ অনুষ্ঠান, বাজি মানে বুড়িমার ছাড়া অসম্পূর্ণ । আমরা যাকে বুড়িমা নামে চিনি অর্থাৎ বুড়িমার বোমের প্যাকেটে যার ছবি দেখতে পাই তার আসল নাম অন্নপূর্ণা দাস । এই অন্নপূর্ণা দাস ছিলেন বাংলাদেশের ফরিদপুরের বাসিন্দা । দেশভাগের সময় ভিটেছাড়া হয়ে চলে আসেন আমাদের পশ্চিমবঙ্গে । পশ্চিম দিনাজপুর জেলার জলদিঘি সরকারী ক্যাম্পে এসে ওঠেন । তখন ছিলেন একেবারে নিঃসম্বল । এর পর চলে কঠিন লড়াই । হাওড়া জেলার বেলুড়ে তার নিজের বাড়ি তৈরি করার পিছনে রয়েছে তার অদম্য লড়াই । আস্তে আস্তে বাংলাদেশ থেকে আসা এই নিঃসম্বল মেয়েটিই হয়ে ওঠেন একজন সফল ব্যবসায়ী । এখনো তার ব্যাবসা রমরমিয়ে চলছে । বেলুড়ে রয়েছে তাদের কারখানা ও দোকান ।
সালটা ১৯৪৮ । দেশভাগ, দাঙ্গায় বিধ্বস্ত পূর্ব পাকিস্তান । ডাক্তার রোগ ধরতে পারেনি, বাঁচানো যায়নি স্বামীকে । স্বামী সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর বাংলাদেশ থেকে দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে একাই ভারতে চলে আসেন । তারপর সবজী বিক্রি করে দুবেলা সন্তানদের মুখে দুমুঠো অন্ন তুলে দিতেন । এরপর গঙ্গারামপুরে বিড়ি বাধার কাজ শুরু করেন । হাতে কিছু টাকা আসায় নিজেই একটি কারখানা তৈরি করেন ।
ছেলেকে দোকানে বসিয়ে চষে ফেলেন উত্তরপাড়া, সালকিয়া, বড়বাজার । কী ব্যবসা করবেন ? কিসে লাভ ? সরস্বতীপুজোর আগে পিলখানার যোগেন্দ্র পালের কারখানা থেকে ঠেলাভর্তি করে প্রতিমা নিয়ে এলেন । বেলুড়ে কোথাও ঠাকুর তৈরি হত না, ছুটতে হত দূরে । হাতের কাছে প্রতিমা পেয়ে সবাই হামলে পড়ল । দোলের আগে রঙের পসরা নিয়ে বসলেন । সেটাও জমল ।
তারপর তার মেয়ের বিয়ে হয় হাওড়া জেলার বেলুড়ে । তারপরই তার আসল সাফল্য শুরু হয় । তিনি বেলুড়ের প্যারিমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে দোকান-সহ একটি বাড়িও কেনেন । সেখানে বিড়ির তৈরির সাথে সাথে আলতা, সিঁদুর, ঘুড়ি, দোলের রং, কালীপুজোর বাজির ব্যবসাও শুরু করেন । নিজে তৈরি না করলেও লাভ হতে লাগল বেশ ভালোই ।
এক দিন দোকানে এক ঝাঁক ছেলেমেয়ে হাজির । “বুড়িমা, লজেন্স দাও !” কী বলল ওরা ? দোকানে রাখা আয়নাটা সামনে ধরলেন । চুলে পাক, শরীরে বয়সের ছাপ । আশ্চর্য, বুড়িমা নামটাও কী ভাবে ছড়িয়ে পড়ল । অন্নপূর্ণা দেবী হয়ে গেলেন ‘বুড়িমা’ । বয়স বাড়ার সাথে সাথে অন্নপূর্ণা দেবীকে সবাই বুড়িমা বলে ডাকতেন । সেই কারণেই তার ব্যাবসার নামকরণ হয় বুড়িমা ।
কালীপুজো । বুড়িমার ইচ্ছে দোকানে বাজি তুলবেন । হাতে পয়সা নেই । ধারের টাকায় বাজি কিনলেন, তার পরই সেই ঘটনা । দোকান ভাঙল পুলিশ । এর ক’দিন পরেই এক দুপুরে ছেলেকে চমকে দিলেন, “এই দেখ বাজি বিক্রির লাইসেন্স । আর বাজি তৈরির অনুমতিপত্রও !”
লাইসেন্স তো হল । কিন্তু কে শেখাবে বাজি বানানো ? বাঁকড়ায় দেখা আকবর আলির সঙ্গে । হাতে ধরে শেখালেন— কাকে বলে সোরা, ব্যাটরা, গন্ধক কী রকম দেখতে । প্রথম মরশুমেই বাজিমাত । সব বিক্রি হয়ে গেল । আকবরের ফর্মুলাতেই তৈরি হল ‘বুড়ীমার চকলেট বোম’ ।
বাজি-কারখানার জন্য তালবান্দা, ডানকুনি, শিবকালীতে জায়গা কিনলেন । ডানকুনিতে মাটি খুঁড়তে বেরল বিশাল শিবলিঙ্গ । চকলেট বোমের লোগো হল তা । কারখানার জন্য কিনলেও তালবান্দার জমি বিলিয়ে দিলেন গরিবদের । এক সময় যাঁর মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না, তিনিই পঞ্চাশটি পরিবারকে বাড়ি বানিয়ে দিলেন । বলতেন, “ব্যবসাটা তুচ্ছ ! এসেছি মানুষকে ভালবাসতে ।”
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক ব্যাবসায়ী আসতেন বুড়িমার কাছ থেকে বাজি কিনতে । বুড়িমার থেকে বাজি কিনে অনেক বেশি দামে বিক্রি করে অনেক লাভ করতেন । তারপর সরকারী নিয়ম মেনে বিভিন্ন জায়গা থেকে বাজির কারীগরদের নিয়ে আসেন এবং তৈরী করেন নতুন ব্রান্ড বুড়িমা । ছেলে সুধীরনাথও মায়ের এই ব্যাবসার সাথে যুক্ত হলেন । বিভিন্ন ধরণের আতসবাজি তৈরি করতে লাগলেন । কিন্তু সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল বুড়িমার চকলেট বোমই ।
১৬/১ পিয়ারীমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বিরাট বাড়ির সর্বত্র বুড়িমা । তাঁর শেষ দিনটা আজও চোখে ভাসে নাতি সুমন দাসের । লোকে ভর্তি বাড়ি, থমথমে । এরই মধ্যে বাইরে কারা ‘বুড়ীমার চকলেট বোম’ ফাটাচ্ছে । শোকের সময় চ্যাংড়ামো ! উত্তর এল, ‘‘চ্যাংড়ামো নয়, জয়ধ্বনি । যে চকলেট বোম বানিয়ে গোটা বাজির বাজার জিতে নিয়েছেন, সেটা ফাটিয়েই বুড়িমাকে শ্রদ্ধা জানালাম !”
শুধু বাজি ব্যবসাতেই থেমে থাকেননি । তিনি তামিলনাড়ুর শিবকাশীতে একটি দেশলাই কারখানা খোলেন । বুড়িমার এই ব্যাবসা এখন তার নাতিরা চালান । বর্তমানে বুড়িমার ব্যাবসা শুধুমাত্র বাজি তৈরিতেই সীমাবদ্ধ নেই । বেলুড়ে তৈরি হয়েছে বুড়িমা মাল্টিজিম যেটি একটি সুসজ্জিত অত্যাধুনিক জিম ।