প্রেমের টানে কানাডার প্রাসাদ থেকে কালনার টিনের ঘরে মেম বউ

0
1791

যোগা শেখাতে গিয়ে প্রেম । তারপরই কালনার যুবকের বউ হতে সাত সমুদ্র ১৩ নদীর পেরিয়ে চলে এলেন কনে । ষষ্ঠীর দিন দুগ্গা দুগ্গা করে মালবদলও হয়ে গেল । এখন সুখেই ঘরকন্না করছেন কানাডিয়ান বউ । অত্যাধুনিক সংস্কৃতি ছেড়ে গ্রাম বাংলার আদব কায়দায় মানিয়ে নিতে অসুবিধা হলেও চেষ্টা করে চলেছেন । সেই বিদেশিনী বউ দেখতে কালনার আশ্রমপাড়ার বাসিন্দা টিঙ্কু রায়ের বাড়িতে ভিড় উপচে পড়েছে । সকাল বিকেল শুধু লোকজনের লাইন রায়বাড়ির সামনে ।

প্রেম কাহিনিটা সেলুলয়েডের গল্পের মতোই ৷ ক্যাথরিনের বাবা সিলেস ওয়ালেট আর মা হেলেনি ফ্রেচেট, দু’জনই নার্সের চাকরি করেন ৷ বোন ভ্যালেরিকে নিয়ে বছরখানেক আগে ভারতে বেড়াতে এসেছিলেন ক্যাথরিন ৷ ঘুরতে ঘুরতে উত্তরাখণ্ডের হৃষিকেশের একটি যোগ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যোগ দেন কানাডার তরুণী । সেখানে আলাপ ও প্রেম যোগ প্রশিক্ষক টিঙ্কুর সঙ্গে । সেই প্রেম আরও গাঢ় হয়, পরিণতি বিয়েতে ।

রায়বাড়ির ছেলে টিঙ্কু যোগা শেখান । দেশের বিভিন্ন জায়গাতেই তাঁর যোগার ক্লাস চলে । প্রশিক্ষণও প্রচারের জন্য বেনারসেও যান টিঙ্কু । গতবছরও গিয়েছিলেন । কাশিতে এক যোগার ক্লাসে আসেন কানাডিয়ান তরুণী ক্যাথরিন অলেটি । তিনি তখন ভারত ভ্রমণে এসেছিলেন । টিঙ্কুবাবুর যোগার ক্লাস তাঁর ভাল লেগে যায় । এরপর কাশিতে থাকাকালীন প্রতিদিন সেই ক্লাসে আসতেন । এই সূত্র ধরেই তাঁদের দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে । একটা সময় ওই যুবক কালনার বাড়িতে ফিরে আসেন । ক্যাথরিন চলে যান কানাডায় ।

কিন্তু যোগাযোগ থেকেই যায় । সেই সূত্রেই বন্ধুত্ব বদলে যায় প্রেমে । বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা । তবে তার আগে ক্যাথরিনের অনুরোধে কানাডা যান টিঙ্কু রায় । তরুণীর বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখাও করেন । বিয়ের কথা পাকা হয়ে যায় । এরপর গত ষষ্ঠীর দিন টিঙ্কুবাবুর বাড়িতেই চলে আসেন ওই তরুণী । এই সম্পর্কে সম্মতি দেন ক্যাথরিনের অভিভাবকরা, যাঁরা আদতে ফরাসি বংশোদ্ভূত । পুরো বাঙালি রীতি মেনে ক্যাথরিন বাঁধা পড়েন সাত পাকে ৷ সুদূর কানাডা থেকে মেয়ে-জামাইকে আশীর্বাদ করেন ক্যাথরিনের মা-বাবা । শুভলগ্নে চার হাত এক হয়ে যায় ।

টিঙ্কু-ঘরণী এখন শাঁখা-সিঁদুর, শাড়ি পরছেন । রুটি বেলছেন । চা করছেন । বাংলা বলছেন— ‘খাব’, ‘ভাত’, ‘ধন্যবাদ’ । আর টিঙ্কুর  পরিবার বলছে, ‘‘মেয়ের খুব সাহস ।’’  ক্যাথরিন তাঁদের কাছে  ঘরের মেয়ে হয়ে গিয়েছেন ।

নতুন বউ ইতিমধ্যেই বাংলা শিখতে শুরু করেছেন । পেশায় স্কুল শিক্ষিকা ক্যাথরিন গ্রাম বাংলার প্রেমে পড়েছেন । গ্রামের মানুষের সরলতা তাঁকে আকৃষ্ট করেছে । কিন্তু ভাষা না জানায় কথা বলতে পারছেন না । সেই অভাব দূর করতেই শুরু হয়েছে নয়া প্রশিক্ষণ । তাঁর কথায়, বিয়ে করে ভালই আছেন নবদম্পতি । এদিকে গ্রামে বিদেশিনী বউ পেয়ে খুশি প্রতিবেশী অরণ মল্লিক । তিনি জানান, মেয়েটি খুব ভাল । এখানে নতুন বউমার পরিবারের কেউ না থাকায় বিয়ের অনুষ্ঠানে তিনিই কন্যা সম্প্রদান করেছেন । এই ধরনের ঘটনা গ্রাম বাংলায় তো খুব একটা দেখা যায় না । তবে প্রেমের টান বড় গভীর । তাই তারা সুখেই থাকবে, তাঁর আশা ।

এই ক’দিনেই আপন হয়ে ওঠা বৌমার সর্বক্ষণ খেয়াল রাখছেন শাশুড়ি দীপ্তি রায় ৷ বললেন, ‘ছেলে আর বৌমা দু’জনেই নিরামিষ খান ৷ তাই ওঁদের জন্য থালা-বাসন সব আলাদা রেখেছি ।’ পূর্বস্থলী কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী, সম্পর্কে ক্যাথরিনের ননদ মনিকা কীর্তনিয়ার পছন্দ হয়েছে বৌদিকে । বলেন, ‘বৌদি খুব খোলা মনের ৷ মুখে সব সময় হাসি লেগে রয়েছে ৷ এই ক’দিনেই সকলের আপন হয়ে উঠেছে ৷’ এ বার পুজোয় টিঙ্কুদের পাড়ায় আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিলেন ক্যাথরিন । টিঙ্কুদের বাড়ির পাশেই পুজো হয় । সবার কৌতূহল বাঙালি বাড়ির মেম বৌকে ঘিরে । ক্যাথরিনও জানালেন, পুজো খুব উপভোগ করেছেন ৷ স্বামীকে নিয়ে ১৫ নভেম্বর কানাডা পাড়ি দিচ্ছেন তিনি ৷ কিছুদিন সেখানে কাটিয়ে ফিরবেন শ্বশুরবাড়িতে ।